ইতিহাস গড়ে সেমিফাইনালে আফগানিস্তান

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

ছন্নছাড়া ব্যাটিংয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে লজ্জার বিদায় নিলো বাংলাদেশ। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই নড়বড়ে ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে যেমন ধুঁকতে দেখা গেছে নাজমুল হোসেন শান্তদের, তেমনই সুপার এইটের শেষ ম্যাচেও আফগানিস্তানের বিপক্ষে চরম ব্যর্থ ছিলেন তারা। ফলে যা হবার তাই হলো- জয়ের কাছাকাছি গিয়েও হতাশার হার নিয়েই মাঠ ছাড়তে হলো বাংলাদেশ দলকে। গতকাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশ সময় সকালে শুরু হওয়া সুপার এইটে গ্রুপ-১ এর গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ ম্যাচে বৃষ্টি আইনে টাইগারদের ৮ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়লো আফগানরা। আগে ব্যাট করে বাংলাদেশের বোলারদের হিসেবি বোলিংয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১১৫ রানের বেশি তুলতে পারেনি আফগানিস্তান। জবাবে পরিবর্তিত লক্ষ্য ১৯ ওভারে ১১৪ রানও করতে পারলো না বাংলাদেশ। ৭ বল বাকী থাকতে ১০৫ রানে অলআউট হয় তারা। ফলে বৃষ্টি আইনে ম্যাচ জিতে নেয় আফগানিস্তান। আফগানদের ইতিহাস গড়া এই জয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সাবেক চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াও ছিটকে গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নবম আসর থেকে। সুপার এইটে গ্রুপ-১ এর তিন ম্যাচে দুই জয় ও এক হারে ৪ পয়েন্ট পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থেকে সেমির টিকিট কাটলো আফগানিস্তান। সমান ম্যাচে তিন জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে আগেই শেষ চার নিশ্চিত করেছে ভারত। বিশ^কাপের মঞ্চে এই প্রথমবার আফগানদের কাছে হারলো টাইগাররা।

কাল টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে সাবধানে ইনিংস গড়ার চেষ্টা করেন আফগানিস্তানের দুই ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরান। পাওয়ার প্লেতে ২৭ রান তুলতে পারেন দুই ওপেনার। এরমধ্যে পঞ্চম ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে ইব্রাহিমের ক্যাচ ফেলেন তাওহিদ হৃদয়। নবম ওভারে আফগানিস্তানের রান ৫০ স্পর্শ করেন গুরবাজ ও ইব্রাহিম। এবারের বিশ্বকাপে এই নিয়ে চারবার অন্তত ৫০ রানের জুটি গড়লেন গুরবাজ-ইব্রাহিম। ফলে বিশ^কাপের ইতিহাসে এক আসরে এই প্রথম কোনো জুটি চারবার ৫০ রান স্পর্শ করলো। ১১তম ওভারে আফগানিস্তানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গেন টাইগার স্পিনার রিশাদ হোসেন। লং অফে তানজিম হাসান সাকিবকে ক্যাচ দেন ২৯ বলে ১৮ রান করা ইব্রাহিম। এবারের বিশ^কাপে গুরবাজ-ইব্রাহিম জুটি মোট ৪৫৫ রান করেছে। বিশ^কাপের ইতিহাসে এক আসরে যেকোন উইকেট জুটিতে যা সর্বোচ্চ। ইব্রাহিমের আউট হলে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সামনে দ্রুত রান তুলতে ব্যর্থ হয় আফগানিস্তান। ৩৯ বল পর ১৪তম ওভারে প্রথম বাউন্ডারির দেখা পায় আফগানরা। এরমধ্যে একটি মেডেন ওভারও নেন পেসার তাসকিন আহমেদ। ১৬তম ওভারে দলীয় ৮৪ রানে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় উইকেট এনে দেন পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। তিন নম্বরে নামা ওমরজাইকে ১০ রানে শিকার করেন তিনি।

১৭তম ওভারে জোড়া উইকেট তুলে নেন রিশাদ হোসেন। ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ৫৫ বলে ৪৩ রান করা গুরবাজকে এবং গুলাবাদিন নাইবকে ৪ রানে ফেরান রিশাদ। পরের ওভারে মোহাম্মদ নবিকে ১ রানে আউট করেন তাসকিন। ফলে ১৮ ওভার শেষে আফগানিস্তানের রান দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ৯৯। মুস্তাফিজের করা ১৯তম ওভারে ১ রানের বেশি নিতে পারেনি আফগানরা। তবে তানজিম সাকিবের করা শেষ ওভারে ২টি ছক্কায় আফগানিস্তানকে ১৫ রান এনে দেন অধিনায়ক রশিদ খান। এতে নির্ধারিত ওভারে পাঁচ ব্যাটারকে হারিয়ে মামুলি সংগ্রহ পায় আফগানরা। শেষ পর্যন্ত ১০ বল খেলে ৩ ছক্কায় ১৯ রানে অপরাজিত থাকেন রশিদ খান। আফগান ইনিংসে ডট বল ছিল ৬৬টি। বাংলাদেশের পক্ষে রিশাদ হোসেন চার ওভার বল করে ২৬ রানে নেন ৩টি উইকেট। এবারের আসরে মোট ১৪ উইকেট শিকার করে সাকিব আল হাসানের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন রিশাদ। বিশ^কাপের এক আসরে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ১৪ উইকেটের মালিক এখন তিনি। ২০২১ সালে সাকিব ও এবারের আসরে তানজিম হাসান সাকিব ১১ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছেন।

আফগানদের স্বল্প পুঁজিতে বেঁধে রাখায় সেমিফাইনালে উঠার দারুণ সুযোগ তৈরি হয় বাংলাদেশ দলের। কিন্তু লক্ষ্য তাড়ায় নেমে যাচ্ছে-তাই ব্যাটিংয়ে সুযোগটা নিতে পারেনি নাজমুল হোসেন শান্তর দল। ১১৬ রানের লক্ষ্য ১২.১ ওভারে স্পর্শ করলেই শেষ চারে খেলতে পারবে বাংলাদেশ। এমন সমীকরণ সঙ্গে নিয়ে ইনিংসের প্রথম ওভারেই লিটন দাসের ১টি করে চার-ছক্কায় ১৩ রান পায় টাইগাররা। পরের ওভারে পেসার ফজলহক ফারুকির বলে এলবিডব্লিউ হন রানের খাতা খুলতে না পারা আরেক ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম। সর্বশেষ চার ইনিংসে তৃতীয়বারের মত শূন্য রানে আউট হওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করেছেন তানজিদ তামিম। এবারের আসরে তিনবার শূন্যতে ফিরে আগেই রেকর্ড গড়েছেন উগান্ডার রজার মুকাসা। শুধু তানজিদ তামিমই নন, নাজমুল হোসেন শান্ত, সাকিব আল হাসান, তাওহিদ হৃদয় কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-কেউই আফগান বোলারদের সামনে একটু বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারলেন না

তৃতীয় ওভারে জোড়া উইকেট হারানোর ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। পেসার নাভিন উল হকের চতুর্থ বলে মিড উইকেটে নবিকে ক্যাচ দেন ৫ বলে ৫ রান করা বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। অধিনায়কের বিদায়ে ক্রিজে এসে আরও একবার ব্যর্থ হন সাকিব আল হাসান। প্রথম বলেই বোলার নাভিনকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে গোল্ডেন ডাক মেরে ফেরেন তিনি। ১২৯ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এটা সাকিবের নবম ডাক। ২৩ রানে ৩ উইকেট পতনের পর চাপে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় জুটি গড়ার চেষ্টা করেন লিটন দাস ও সৌম্য সরকার। ২২ বলে ২৫ রান যোগ করে উইকেটে সেট হন তারা। সপ্তম ওভারে প্রথমবারের মত আক্রমণে এসেই আফগানিস্তানকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন অধিনায়ক রশিদ খান। ১০ বলে ১০ রান করা সৌম্যকে দারুণ ডেলিভারিতে বোল্ড করেন তিনি। সৌম্যর পর আরও ৩ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেন রশিদ। তাওহিদ হৃদয়কে ১৪, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ৬ ও রিশাদকে শূন্যতে বিদায় দেন রশিদ। এতে ১১ ওভারে ৮০ রানে সপ্তম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ১২.৪ ওভারের পর বৃষ্টিতে তৃতীয়বারের মত বাংলাদেশের ইনিংসে খেলা বন্ধ হলে, বৃষ্টি আইনে জিততে ১৯ ওভারে ১১৪ রানের নতুন লক্ষ্য পায় টাইগাররা। তবে এরআগে ১২.১ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ৮৩ রান তুলতে পারায় বিশ^কাপের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বাংলাদেশের।

সপ্তম উইকেট পতনের পর ২০ বলে ১২ রান তুলেন লিটন ও তানজিম সাকিব। ১৫তম ওভারে প্রথম বোলিংয়ে এসে দলীয় ৯২ রানে তানজিমকে ৩ রানে আউট করেন পেসার গুলবাদিন নাইব। এরপর নবম উইকেটে তাসকিনকে নিয়ে ২০ বলে ১৩ রান যোগ করে বাংলাদেশের জয়ের আশা বাঁচিয়ে রাখেন লিটন দাস। একপ্রান্তে তিনি দাঁড়িযে থেকে বেশ ভালোভাবে চেষ্টা করেছিলেন রানকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু শেষ দিকে লিটন যা করলেন এক কথায় তা দায়িত্বজ্ঞানহীন। দল যখন জয়ের খুব কাছাকাছি তখন লিটন নিজের হাফসেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পরও হাত খুলে খেলেননি! ওই সময় যেখানে লিটনের বড় শট খেলার কথা, সেখানে তিনি সিঙ্গেল রান নিতেই ব্যস্ত থাকলেন। বলা যায় সম্মিলিত ব্যর্থতায় সেমিতে ওঠা হলো না টাইগারদের। ১৮তম ওভারের চতুর্থ বলে তাসকিনকে ২ রানে বোল্ড করে বাংলাদেশের নবম উইকেটের পতন ঘটান নাভিন। পরের ডেলিভারিতে মুস্তাফিজকে এলবিডব্লিউ করে দলের জয় নিশ্চিত করে আফগানিস্তানকে সেমিফাইনালে তুলেন নাভিন। শেষ পর্যন্ত ৫টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪৯ বলে ৫৪ রানের ইনিংস খেলেও দলের হার রুখতে পারেননি লিটন।

আফগানিস্তানের নাভিন ২৬ রানে ও রশিদ ২৩ রানে পান ৪টি করে উইকেট। এ ইনিংস দিয়ে টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশিবার ৪ উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে সাকিবকে ছাড়িয়ে গেছেন রশিদ। সাকিব আটবার ও রশিদ ৯ বার ইনিংসে ৪ উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা হন নাভিন।

আগামীকাল ত্রিনিদাদে বিশ^কাপের প্রথম সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে আফগানিস্তান। বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৬টায় শুরু হবে ম্যাচটি। একই দিন রাত সাড়ে ৮টায় গায়ানায় দ্বিতীয় সেমিতে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে ভারত।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm