সুলতান মনসুরের এমপি পদ কি টিকবে?

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর সংসদ সচিবালয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে শপথ নেন তিনি।

এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সুলতান মনসুর শপথ নেয়ার তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম।দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে গণফোরামের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সুলতান মনসুরকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানান গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দলীয় শৃংখলা বিরোধী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আদর্শবিরোধী কাজ করায় সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হল। সেই সঙ্গে তার দলীয় প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হল।

মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে।তিনি ভোটে জয়ীও হন।তখন আমরা তাকে স্বাগতও জানিয়েছিলাম।

তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের তামাশার নির্বাচনে ফল প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় ঐক্যফ্রণ্ট ও গণফোরাম। সেই সিদ্ধান্তের কথা সুলতান মনসুরকে জানানোও হয়।জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি শপথ না নিলেও সুলতান মনসুর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আজ সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন।তাই গণফোরাম তাকে দল থেকে বহিষ্কার করছে।তার প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করা হলো।

গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক জানান, সুলতান মনসুরের বহিষ্কারের চিঠি স্পিকার বরাবর পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গণফোরাম বহিষ্কার করায় সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্য পদ কি টিকবে? এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।

সুলতান মনসুর শপথ নিলেও সংসদ সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে পরস্পর বিরোধী মত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দুই কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হতে পারে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য যদি তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন (ফ্লোর ক্রসিং) অথবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে যদি শপথ না করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে তার সংসদ সদস্যপদ যাবে না। তবে এ ব্যাপারে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ নেই।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে কেউ শপথ না নিলে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। তাছাড়া সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলেও তার সদস্যপদ থাকবে না।

এক প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্য যদি তার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেন এবং দল যদি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি আটকে যাবেন। অর্থাৎ তাদের সদস্যপদ থাকবে না। সেক্ষেত্রে গণফোরামের নির্বাচিত দুইজন শপথ নিলেও দল না চাইলে তাদের সদস্যপদ থাকবে না।

সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য নির্বাচনের পর এমপি পদে থাকার অযোগ্য হবেন কি না, কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সাংসদের আসন শূন্য হবে কি না—এ সম্পর্কিত কোনো বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সুলতান মনসুর দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার বিষয়টি তো আরও পরের কথা। তবে তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাঁকে বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।এই যুক্তিতে সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্যপদ টিকে যেতে পারে।

অতীতেও এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে।নবম সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তাঁর সদস্যপদ স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে বহাল ছিল।

এর আগে অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তাঁর সদস্যপদ বহাল ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই সংসদের ব্যাখ্যা ছিল, দল তাঁদের বহিষ্কার করেছে কিন্তু তাঁরা দল থেকে পদত্যাগ করেননি। যে কারণে তাঁদের সদস্যপদ বহাল ছিল।

দশম সংসদে সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে পদত্যাগ করেন। এ কারণে তিনি সংসদ সদস্যপদ হারান।

এমতাবস্থায় গণফোরাম সুলতান মনসুরকে বহিষ্কারের পর স্পিকারকে চিঠি দিলে স্পিকার বিতর্কটি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।

প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে নাম লিখিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে ভোট করে জয়ী হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। আর দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন প্রবাসী মোকাব্বির খান গণফোরামের দলীয় প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে সিলেট-২ আসন থেকে জয়ী হন। ওই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী না থাকায় বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরাম একাদশ নির্বাচনের ফল বর্জন করে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত অপর পাঁচ সদস্য শপথ না নিলেও একাদশ সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির। পরে অবশ্য শেষ মুহূর্তে ভোল পাল্টান মোকাব্বির। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শপথগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন তিনি।

মোকাব্বির শপথ না নিলেও শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন সুলতান মনসুর। আজ তিনি শপথ নিয়েই নিলেন।

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর শপথ নিলেই তার বিরুদ্ধে দলীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল গণফোরাম। দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি স্পিকারকেও অবহিত করা হবে।

বুধবার বিকালে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে বৈঠক করেন গণফোরামের শীর্ষ নেতারা। এই বৈঠকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেউ শপথ নিলে তার বিরুদ্ধে দলীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি স্পিকারকে লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। দলের এই সিদ্ধান্তের পরপরই সুর বদলান মোকাব্বির খান। আপাতত শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

তবে দলীয় সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা না করে শপথ নিলেন সুলতান মনসুর। তিনি আগেই বলেছিলেন, ড. কামাল না চাইলেও তিনি শপথ নেবেন।আর গণফোরাম বলে আসছিল, দলের ব্যানারে ভোট করে নির্বাচিত সুলতান মনসুর কিছুতেই দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে পারেন না।

এ বিষয়ে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বুধবার যুগান্তরকে বলেছিলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেউ শপথ নিলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। দলীয় সিদ্ধান্ত এবং আইনগত সিদ্ধান্ত যা নেয়া দরকার, সেগুলো আমরা নেব।

এ বিষয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীও আগেই বলেছিলেন, বর্তমান সংসদে ঐক্যফ্রন্টের কোনো সংসদ সদস্য শপথ নেবে না এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।এর বাইরে যে যাবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজ সেই সাংগঠনিক ব্যবস্থাই নেয়া হল। বহিষ্কার করা হল সাবেক ডাকসু ভিপিকে।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm