এবার বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে সরাসরি ছুটে চলবে ভারতের ট্রেন। ভারতের মালবাহী ট্রেন গেদে সীমান্তবর্তী রেলস্টেশন দিয়ে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে এরপর দর্শনা রেল স্টেশন থেকে পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরের আব্দুলপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ী স্টেশনে পৌঁছাবে। সেখান থেকে রেলপথে ভুটান সীমান্তবর্তী ভারতের ডালগাঁও স্টেশন পর্যন্ত মালবাহী ট্রেন নিয়ে যেতে চায় ভারত। পুরো ব্যবস্থাটি হচ্ছে ভারত থেকে ভারতমুখী। অর্থাৎ একতরফা ও একমুখী অভিনব রেল ট্রানজিট। সরাসরি ট্রানজিট রুটে ভারত পরীক্ষামূলক মালবাহী ট্রেন আগামী মাসেই নিয়ে যেতে চায়। গত ২২ জুন নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যকার শীর্ষ বৈঠকে যে দশটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তি হয়েছে এর মধ্যে গুরুত্বের শীর্ষে রেলওয়ে ট্রানজিট বা কড়িডোর চুক্তিটি। বাংলাদেশের ভূখ- দিয়ে সরাসরি ভারতের মালবাহী ট্রেন চলাচল চুক্তিকে ঘিরে সচেতন সাধারণ নাগরিকমহলে নানামুখী প্রশ্ন সংশয় উচ্চারিত হচ্ছে ঘুরেফিরে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে রেল ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের লাভ কী? গত শনিবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে তীব্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরির বিষয়ে শঙ্কা ও গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকগণ।
বর্তমানে ৫টি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করলেও সেগুলো চলে ‘ইন্টারচেঞ্জ’ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ ভারতের ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশী ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশি লোকো মাস্টার (চালক) ট্রেন চালিয়ে আনেন। ফিরতি সময়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে ভারতের প্রান্তে মালামাল পৌঁছে দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু নতুন চুক্তি মাফিক ভারতের মালবাহী ট্রেন পশ্চিমবঙ্গের গেদে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং ভারতের চালক দ্বারা চালিত হয়ে সেই ট্রেন দর্শনা হয়ে বাংলাদেশের ভূখ-ের ভেতর এবং একাধিক স্টেশন দিয়ে ভারতে যাবে সরাসরি। চুক্তি শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রেল ট্রানজিট চালু হলে নিজ দেশের মধ্যে রেলপথে দূরত্ব অনেকখানি কমবে ভারতের। ভারত আগে থেকেই এটা চেয়েছিলো। এটা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি পরিকল্পনাও এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে’। এবার শীর্ষ বৈঠকে রাজশাহী থেকে সরাসরি কলকাতায় ট্রেন চলাচলেও সমঝোতা হয়েছে।
তাছাড়া ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশ অংশে ১০ কিলোমিটার ও ভারতের অংশে সাড়ে ৫ কি.মি. রেলপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে আখাউড়া-আগরতলা নয়া ট্রানজিট রেল রুট (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর থেকে ভারতের নিশ্চিন্তপুর এবং নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা রেল স্টেশন) বিগত ১ নভেম্বর’২৩ইং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন। এসব রেলপথে ট্রানজিট রুট বা রেলওয়ে কড়িডোর চালু হয়ে বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে দেশটির মূল ভূখ-ের দূরত্ব এবং যাতায়াতে সময় কমে যাবে চার ভাগের তিন ভাগ পর্যন্ত। লাভের উপর ভারতের বাম্পার লাভ অন্তত চার গুণ।
যেমন- দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার বর্তমান দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কি.মি.। আখাউড়া-আগরতলা নয়া ট্রানজিট রেল রুটের সুবাদে কলকাতা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সরাসরি আখাউড়া-আগরতলার সেই দূরত্ব ১১শ’ কি.মি. কমে গিয়ে দাঁড়াবে মাত্র ৫৫০ কি.মি.। এতে ভ্রমণ সময় লাগবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা। ভারতীয়দের বাঁচবে প্রচুর সময় ও অর্থ। গেদে-দর্শনা দিয়ে চিলাহাটি হয়ে হলদিবাড়ী-ডালগাঁও প্রস্তাবিত সরাসরি রেল ট্রানজিটেও একইভাবে ঘুরপথের দূরত্ব, সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশের কাছে ভারতের আবদারের শেষ নেই। ‘আবদার-অভিলাষ’ পূরণের ফিরিস্তিতে প্রতিবেশী দেশটির জন্য এ যাবৎ সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিযোগ ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা লাভ। যা চালু করা হয়েছে ‘কানেকটিভিটি’ কিংবা ’ট্রান্সশিপমেন্টে’র নামে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্যসামগ্রী ওঠানামা, পরিবহণের ট্রানজিট এবং স্থলপথে তথা সড়ক-মহাসড়ক হয়ে দেশের চারটি করিডোর রুট দিয়ে ট্রানজিটের পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। যা একমুখী তথা ভারতমুখী। সদ্য নয়াদিল্লী শীর্ষ বৈঠকে রেলপথে ট্রানজিটা চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ভারতের ট্রেন ভারতেরই মালামাল নিয়ে বাংলাদেশের ভূখ- দিয়ে যাবে ভারতেই। তাও একমুখী।
লাভালাভের বিষয় এখনো অজানা : ভারতকে রেল ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে তার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে তা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। ভারত-বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত নতুন রেল ট্রানজিট চুক্তিটির বিষয়ে দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করায় লাভ-ক্ষতির বিষয়টি এখনও বোঝা যাচ্ছে না। নতুন এই রেল ট্রানজিট চুক্তিরশর্ত, ফি-চার্জ-মাশুল, অর্থায়ন কিংবা অন্য কোনও বিষয়ে এখনও বিষদ কিছু জানানো হয়নি। তবে ট্রানজিটের অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের লাভের বিষয়ে তেমন কোন আশাবাদী হতে পারছেন না বিশ্লেষকগণ। তাছাড়া এই ট্রানজিট রুট চালু করার নতুন করে রেলপথ নির্মাণ হবে নাকি বর্তমানে যে অবকাঠামো আছে তা সংস্কার করা হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট কোন বক্তব্য আসেনি। ট্রানজিট পাওয়ার পর দর্শনা থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত যে রেল লাইনটি ভারত ব্যবহারের সুবিধা পেতে যাচ্ছে তার উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার খরচ ভারত দেবে কিনা তাও স্পষ্ট করেনি।
চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ার হিসাব-নিকাশে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি মোটাদাগে কী? এ যাবত কতদূর? স্বভাবতই এ ধরনের অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বন্দর-শিপিং বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি কিংবা নিরপেক্ষ সচেতন নাগরিক মহলের মাঝে।
সদ্য নয়াদিল্লী শীর্ষ বৈঠকে ভারতকে রেল ট্রানজিট সুবিধার চুক্তি প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ট্রানজিট বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অনেকদিন থেকেই ভারতের জ্ঞানে (মাথায়) রেল ট্রানজিটের বিষয়টি আছে। এগুলো সবই ভারতের স্বার্থ পূরণ করবে। এসব সমঝোতা কিংবা চুক্তি কোনটাই বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লী সফরে ভারত যা কিছু চেয়েছে তার সবই পেয়েছে। ভারত একতরফা লাভবান হচ্ছে। এখানে বাংলাদেশের কিছুই প্রাপ্তি নেই। হবেও না। আগেও হয়নি। ড. মইনুল ইসলাম অবশ্য ট্রানজিটের কারণে নিারাপত্তায় ঝুঁকি দেখছেন না।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের প্রফেসর ড. মো. শামছুল হক ইনকিলাবকে বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত ও আঞ্চলিক সংযোগের গুরুত্বের কারণে আয়ের যে সুযোগ তা একতরফা হওয়া কাম্য নয়। চুক্তিতে ভারত কতটা লাভবান হচ্ছে আমরা কতটা লাভবান হচ্ছি তার শেয়ারিং নিশ্চিত হতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমি আঞ্চলিক কানেকটিভিটির (সংযোগ) পক্ষে। এখানে এক দেশের ট্রেন আরেক দেশের রেলপথে চলবে, আমাদের রেল লাইন অবচয় বা চাপ নেবে। এদেশের জনগণের টাকা দিয়েই এসব রেলপথ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিরাপত্তার দিক সুনিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য একলা উন্নয়ন নয়; চুক্তি এতকরফা হলে সেটা টেকসই হয় না। আমরা লাভবান হওয়ার জন্য ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ তৈরি করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমার হিস্যা আমাকে বুঝে নিতে হবে। রেলওয়ে মন্ত্রণালয় ও রেল কর্তৃপেক্ষর এসব বিষয় দক্ষতার সঙ্গে নেগোশিয়েট করা প্রয়োজন।
নিরাপত্তায় ঝুঁকির প্রশ্ন ও উদ্বেগ : ‘ভারতকে রেল ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে’? শীর্ষক সোমবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, এ যাবৎ যা অভিজ্ঞতা তাতে বলা যায় যে, নতুন এই চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ তেমন কিছু পাবে না। এর আগেও বলা হয়েছিলো যে, (ভারতকে ট্রানজিটের বিনিময়ে) বছরে প্রায় পাঁচশ’ মিলিয়ন ডলারের মতো লাভ হবে। কিন্তু পরে আদৌ কী কোনও মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে? তেমন কিছু তো শোনা যায় না।
সরাসরি রেল চলাচল ট্রানজিটের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রশ্নে সাবেক কূটনীতিক মো. তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলা’কে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেসব রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেসব (অঞ্চলে) অভিযানে ভারত হয়তো এই রেলপথ ব্যবহার করতে চাইবে। এসব রাজ্যে অতীতে ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে চীন-ভারত সীমান্তেও বিভিন্ন সময় সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা গেছে। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বা দুঃসময়ে ভারত অবশ্যই এসব ট্রানজিট রুট ব্যবহার করতে চাইবে এবং সেটিই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ট্রানজিটে নিরাত্তার ঝুঁকি প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলা’কে বলেন, ট্রানজিট দেওয়ার পর সেটির উপর বাংলাদেশ কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে, তার উপরেই নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে। ট্রানজিটে যদি শুধুমাত্র পণ্য পরিবহনের কথা বলা থাকে, তাহলে সেটি ছাড়া ট্রেনে অন্যকিছু আনা-নেওয়া করা হচ্ছে কিনা, সেটি যদি ঠিকমত দেখা না হয় বা সেটির নিয়ন্ত্রণ যদি বাংলাদেশের হাতে না থাকে, তাহলে তো সমস্যা হতেই পারে।
বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারতকে এ ধরনের ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি চীন কীভাবে নেয়, সেটির উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে। বাংলাদেশ এতদিন ভারত এবং চীনÑ উভয়ের সঙ্গেই একটি ব্যালান্স (ভারসাম্য) সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। এখন ভারতকে সরাসরি ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি চীন যদি ভালোভাবে না নেয়, তাহলে অনেক কিছুই হতে পারে। #