গুলির পর পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় লোকজন

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার জেরে প্রায় ১০ ঘণ্টা থানা ঘেরাও করেন স্থানীয় জনতা। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত দুইটায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ থানার সামনে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার দুপুরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।

এদিকে পুড়িয়ে দেওয়া বানিয়াচং থানার সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া ১৫ পুলিশ সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।

গতকাল দুপুরে উপজেলার এল আর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে জড়ো হন কয়েক শ লোক। পরে তাঁরা একটি মিছিল নিয়ে বড় বাজার হয়ে থানার সামনে দিয়ে রওনা হন। পথে ঈদগাহ এলাকায় তাঁদের বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন, হাসপাতালে আরও তিনজনসহ মোট ছয়জন নিহত হন।

নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে থানার সামনে জড়ো হন। একপর্যায়ে কয়েক হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করেন। শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে থানা ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন ক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় থানার ভেতরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশের ১৫ থেকে ১৬ সদস্য আটকা পড়েন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১৫ জন নেতা-কর্মী আটকা পড়েন। তাঁরা থানা ঘেরাওয়ের আগে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। বিক্ষোভকারীদের ধাওয়ায় থানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

থানা ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে বেলা তিনটার দিকে জেলা সদর থেকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু কোনোভাবেই সেনাবাহিনী থানা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। এভাবে সময় গড়িয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত ক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে রাখেন। এরপর মধ্যরাতে সদর থেকে বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছসহ বেশ কিছু নেতা ঘটনাস্থলে গিয়ে লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু লোকজন শুনছিলেন না। পরে ক্ষুব্ধ লোকজন রাত একটার দিকে সেনাবাহিনীকে প্রস্তাব দেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ও থানার উপরিদর্শক সন্তোষ দাশ চৌধুরীকে তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনী রাজি হয়নি। পরে সেনাবাহিনী জানায়, থানার ভেতরে ওই আওয়ামী লীগ নেতা নেই। পরে জেলা বিএনপি ও স্থানীয় সুশীল সমাজের অনুরোধে লোকজন শান্ত হন।

রাত দুইটার দিকে থানার দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্য ও নেতাদের উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে ওঠানোর সময় উপপরিদর্শক সন্তোষ দাশ চৌধুরীকে উপস্থিত লোকজন ছিনিয়ে নিয়ে সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশ নিয়ে বানিয়াচং বড় বাজার শহীদ মিনারের মাঠে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ভোররাতে লাশ থানার সামনে এনে ফেলে রাখা হয়। আজ সকাল ১০টার দিকে ক্ষুব্ধ লোকজন লাশ থানার সামনে একটি আকাশিগাছে ঝুলিয়ে রাখেন। দিনভর হাজারো মানুষ লাশ দেখতে থানা প্রাঙ্গণে ভিড় করেন। এদিকে গাছে লাশ ঝোলানোর খবর পেয়ে আজ বেলা দুইটায় সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।

বানিয়াচং উপজেলা সদরে দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের সব ক্ষোভ ছিল ওই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। কারণ, তিনি চাকরি করার সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতেন। এ ছাড়া এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর গোপন ব্যবসা ছিল। এ জন্য ক্ষুব্ধ লোকজন তাঁকে মেরেছেন।’

কায়সার হোসেন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, লোকজন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা হায়দারুজ্জামানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি ঘটনার আগে বন্দুক নিয়ে বিক্ষোভকারীদের তেড়ে যান ও হুমকি দেন। সবার ধারণা ছিল, তিনি থানার ভেতরে আছেন। এ জন্য লোকজন প্রায় ১০ ঘণ্টা থানা ঘেরাও করে রাখেন।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বানিয়াচং থানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সেনাবাহিনী। এর আগে থানার ভেতরে ব্যাপক লুটপাট হয়। এমনকি থানার অবকাঠামোগত নানা জিনিসপত্র লুট হয়। পাশাপাশি থানা লাগোয়া জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতেও আগুন ধরিয়ে সবকিছু লুট করে নেওয়া হয়।

হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর ওই থানার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমানে থানায় যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের পুলিশ লাইনসে যুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে নিহত ছয়জন, জনতার হাতে নিহত স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী সোহেল আখঞ্জীসহ সাতজনের জানাজা স্থানীয় এল আর স্কুলমাঠে আজ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। লাশগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করেন স্বজনেরা।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এএসআই আশরাফুল ওই এলাকায় জমি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। এর জের ধরে মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এএসআই আশরাফুল ইসলাম একজনকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে ডেকে পাঠান। তিনি গেলে দুজনের মধ্যে একপর্যায়ে কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় মিজানুরকে মারধর করা হলে তাঁকে রক্ষা করতে নাসির নামের এক ব্যক্তি এগিয়ে যান। তাঁকেও মারধর করেন আশরাফুল। একপর্যায়ে আশরাফুল পিস্তল বের করেন। তখন স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে পিস্তল কেড়ে নিয়ে পিটুনি দেন। পরে আশরাফুল ইসলামকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কেড়ে নেওয়া পিস্তল পরে সেনাবাহিনী গিয়ে উদ্ধার করেছে। মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছয়-সাত দিন আগেও তাঁরা (আশরাফুলরা) এসে তাঁর বাড়িতে হামলা করেছেন। আশরাফুল জমির ব্যবসা করেন। আজকে পিস্তল বের করে গুলি করতে চেয়েছিলেন তিনি। লোকজন ছিল বলে বেঁচে গেছেন বলে জানান মিজানুর। পরে লোকজন পিস্তল কেড়ে নেয়। সেনাবাহিনী এসে পিস্তলটি উদ্ধার করে নিয়ে গেছে বলে তিনি জানান।

LifePharm