আবু সাঈদ মহাকাব্যের ক্যারেক্টার : ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তোমাদেরকে সালাম দিতে এসেছি। তোমরা আমাদের মুক্ত করেছো। আজকে গেলাম আবু সাঈদের বাড়িতে। সে শুধু এখানে প্রাণ দিয়েছে তা না।’

তিনি বলেছেন, ‘আমরা মহাকাব্য পড়ি না, মহাকাব্যের নায়ক থাকে, কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে। আমরা মনে করি এই নায়ক নায়িকারা কী সাংঘাতিক রকমের ক্যারেকটার। আবু সাঈদ হলো মহাকাব্যের ক্যারেক্টার। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে বহুত কাব্য, বহুত সাহিত্য, বহুত কিছু রচনা হবে। বিষয়টা হচ্ছে সে যেটা দেখায়া গেল। চমকে দিয়েছে সবাইকে। সে গুলিটা খেয়ে যে ছবিটা দেখালো, আর মানুষকে থামানো যায়নি। আর থামানোর উপায় নেই। সবাই তখন বলছে, আমিই আবু সাঈদ, আমি আবু সাঈদ। সে যখন জীবন দিয়েছে, আমিও দেবো। সারাদুনিয়া চমকে গেছে। তোমরা যেটা করেছো এটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা নয়, সবাই দেখতেছে, কী ভীষণ ব্যাপার।

শনিবার (১০ আগস্ট) দুপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সিন্ডিকেট রুমে শিক্ষার্থীদের সাথে সোয়া ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘একটা সরকার, এই ছাত্ররা কিভাবে উঠায়ে ফেলতে পারে তোমরা সেটা পেরেছো। যেটা তোমার করছো সেটা হলো আমাদের দ্বিতীয় বিজয় উৎসব। এই বিজয় উৎসবটা যেন আমাদের হাত থেকে ফসকে না যায়। এটা তোমরা পারবা, আমরা কেউ পারব না। আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, আমরা কথা বলব, বক্তৃতা দেবো, সব করব, কিন্তু তোমরা যেটা করেছো সেটা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’

এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তার গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময়ের গল্প শোনান। তিনি বলেন, ‘সে সময় নারীদের হাতে টাকা দিয়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের ছিল। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছি। ধীরে ধীরে নারীদের উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে সামাজিক ব্যবসার মডেল।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ তরুণদের বাংলাদেশ। তরুণদের এখন কেউ টেনে রাখতে পারবে না। পথ পরিষ্কার করতে হবে।’

সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা কি দেশের মানুষ না? তারা কয়টা পরিবার? পুরো দেশ রক্ষা করতে পারছো, আর এ কয়েকটা পরিবারকে তোমরা (শিক্ষার্থীরা) রক্ষা করতে পারবা না? এরা তোমাদের সাথেই আন্দোলনে ছিল। বাড়ি গিয়ে দ্যাখে তার ঘর লুটপাট হয়ে গেছে, এগুলো লুটপাটওয়ালাদের কাজ।’

তিনি বলেন, ‘তোমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের নিরাপদে রাখবা। বলবা, সবাই আমরা ভাই। বাংলাদেশ এক পরিবার। পৃথিবীতে বহু দেশ আছে, এত সুন্দর পরিবার নেই। এত সুন্দর একটা দেশ, কোথায় চলে যেতে পারতাম আমরা! শুধু মনটা শক্ত রাখতে পারলে হতো। আর তোমাদের (তরুণ) রাস্তা খুলে দিলে আমরা মুক্ত হয়ে যেতাম।’

কিছু ব্যক্তি অন্যের মদদের সহিংসতা করছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘গোলমাল লাগাতে পারলে তাদের খুব মজা। সব সময় তারা চেষ্টায় আছে তোমাদের আটকে দেয়ার জন্য।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া নারীদের মুক্ত করেছেন। এখন রংপুর পুরো বাংলাদেশ মুক্ত করবে।’

পরে এই নোবেল লড়িয়েট শোনেন সমস্বয়ক ও শিক্ষার্থীদের কথা। এ সময় শিক্ষার্থীরা একজন ‘মেরুদণ্ডওয়ালা’ জাতীয় শিক্ষাবিদ ভিসি দাবি করেন ক্যাম্পাসে। তুলে ধরেন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাসস্তবায়নের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের বৈষম্য দূরিকরণের কথা। দাবি করেন সুষম উন্নয়নের জন্য শিল্পকলকারখানা স্থাপনসহ নানা বিষয়। শিক্ষার্থীদের কথায় ‍উঠে আসে সিটি করপোরেশনসহ সব ক্ষেত্রের বাজেট বৈষম্য, শ্যামাসুন্দরী খাল পুনর্জীবনের কথা। বলেন আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মানের কথা। শিক্ষার্থীরা ড. ইউনূসকে বলেন, ব্রডগেজ রেল লাইন, বাসাবাড়ি ও শিল্প কলকারখানায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের দাবি। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিন্ডেকেট ভেঙে না দিলে উত্তরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে না। খুলে দেয়ার দাবি জানান, শ্যামপুর সুগার মিলের। তারা আবু সাঈদসহ সকল শহীদদের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।

এ সময় গভীর মনোযোগের সাথে এসব কথা শোনের ড. ইউনূস। শিক্ষার্থীদের কাছে নেন নোট। তিনি বলেন, ‘রংপুরের বৈষম্য দূর করার বিষয়টি তাদের অ্যাজেন্ডায় থাকবে।’

শিক্ষার্থীরা মতবিনিময় সভায় ড. ইউনূসকে রংপুর অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণে যে স্পস্ট দাবি তুলে ধরেন অতীতে কোনো সরকার প্রধানের কাছে এভাবে তা কেউই তুলে ধরেননি।

পরে তিনি সেখান থেকে যান রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আহত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। তাদের খোঁজখবর নেন। এছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে সিন্ডিকেটের বিষয় নিয়ে কথা বলেন। পরে যান সার্কিট হাউজে। সেখানে কথা বলেন সাংবাদিকদের সাথে। প্রতিশ্রুতি দেন উন্নয়নের সম-অংশিদার হবে রংপুর।

এর আগে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রংপুরের পীরগঞ্জে মেরিন অ্যাকাডেমিতে পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে গাড়িবহরে করে জাফরপাড়ার বাবনপুরে আসেন। ১১টা ৩ মিনিটে তিনি আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন। সেখানে তিনি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন। পরে তিনি আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন।

এ সময় ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা আবু সাঈদের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই আবু সাঈদ। আবু সাঈদের মা সবার মা। এখানে যারা আছে (আবু সাঈদের পরিবার) তাদের রক্ষা করতে হবে। তার মা আছে, বোন আছে, তাদের রক্ষা করতে হবে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আবু সাঈদ এখন ঘরে ঘরে। প্রত্যেক ঘরে আবু সাঈদ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবারই সন্তান। এখানে হিন্দু পরিবার হোক, মুসলমান পরিবার হোক, খ্রিস্টান পরিবার হোক, বৌদ্ধ পরিবার হোক সবার ঘরের সন্তান এই আবু সাঈদ। কাজেই আপনারা খেয়াল রাখবেন, কোথাও যেন কোনো গোলোযোগ যেন না হয়। কেউ ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা না বলে। কারণ আমরা এই মাটিরই সন্তান, সবাই আবু সাঈদ।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বলেন, ‘জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই মাটির সন্তানদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আমরা যেন এটা নিশ্চিত করি। আবু সাঈদ যেমন দাঁড়িয়েছে, আমাদেরকেও সেভাবে দাঁড়াতে হবে। যারা পার্থক্য করে, এ রকম সন্তান ওরকম সন্তান, এ রকম না। আমরা সবাই বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশেরই সন্তান। আবু সাঈদের মা সবার মা এবং সবার মা আবু সাঈদের মা। কাজেই তাকে রক্ষা করতে হবে, তাদের বোনদের রক্ষা করতে হবে, তাদের ভাইদের রক্ষা করতে হবে। সবাই মিলে এটা করতে হবে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আবু সাঈদসহ অন্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্মরণ রেখে এগিয়ে যাওয়া সকলের দায়িত্ব। আবু সাঈদ ও অন্যদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্মরণ রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অধ্যয়নরত তরুণ-তরুণীরা আবু সাঈদকে স্মরণ রাখবে এবং তার মতো হওয়ার অঙ্গীকার করবে। তারা বলবে, আমিও আবু সাঈদের মতো ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করব।

অধ্যাপক ইউনূস সকলকে যেকোনো নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার এবং কেউ যেন কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আমরা এই মাটির সন্তান, আমরা সবাই আবু সাঈদ।’

এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া সাথে ছিলেন। এছাড়াও রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসানসহ জেলা ও উপজেলার প্রশাসনের ঊর্দ্ধতন কর্মকতারা উপস্থিত ছিলেন।

ড. ইউনূসের আগমন ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে ওই এলাকায়। সেনাবাহিনীর সদস্যসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যরা সেখানে অবস্থান করছেন। তবে পুলিশের উপস্থিতি ছিল না।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm