কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত ১৯ জুলাই নিহত হন ৯ শ্রেণির শিক্ষার্থী রুস্তম(১৫) নামে এক কিশোর।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পেরোলেও থামেনি স্বজনদের শোক-আহাজারি। স্বপ্ন বুনা শিক্ষার্থী ছেলের মৃত্যুতে এখন শোক সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার।
নিহত রুস্তম নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা মো মাঈনুদ্দিনের ছেলে। রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
দুই ভাই এক বোনের মাঝে সে মেঝো ছিলেন। বাবা দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ ঢাকার মিরপুরের একটি টেইলারিং দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করে ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন।
নরসিংদী রায়পুরার মির্জাপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে মা এখন পাগলপ্রায়। ছেলের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করে মুর্ছা যাচ্ছেন মা মাসুফিয়া। অশ্রুশিক্ত নয়নে পানি ঝরছে।
তিনি বলছেন, ছেলে আমার জুমার নামাজ শেষে বাসায় এসে খেতে বসে বন্ধুর ফোন পেয়ে বলে, ‘মা আমরা যদি এ যুদ্ধে না যাই দেশ স্বাধীন হবে কি করে? অধিকার আদায় করতে হবে।’ এই বলে বাসা থেকে বের হয়। সে খুব মেধাবী, সাহসী, প্রতিবাদী, ভয়হীন ছিলো। পরিবারের চিন্তা না করে দেশের চিন্তা করে আন্দোলনে চলে গিয়ে নির্দোষ ছেলে গুলিতে মারা গেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় খবর এলো ছেলে গুলিবিদ্ধ।ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। তাকে হারিয়ে নিঃস্ব। আমার ছেলে হত্যার বিচার ও শহীদী মর্যাদা চাই।
শিক্ষার্থী বোন বৃষ্টি বলেন, গত ১৮ জুলাই জুমার নামাজ শেষে বাসায় আসে। বেলা সাড়ে ৩ টায় রুস্তম ফোন পেয়ে বাসা থেকে বের হয়। পুরো এলাকায় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে। পুরো পরিবার তার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছিলাম, সে কখন বাসায় আসবে। হঠাৎ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সঙ্গে থাকা তার বন্ধুদের মাধ্যমে ভাই গুলিবিদ্ধের খবর পাই।
সন্ধ্যা ৭টার পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পাই গলায় গুলি ক্ষত। হাসপাতাল থেকে মৃত সার্টিফিকেটবিহীন তাকে রাতে রায়পুরার বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন দাফন করি।
জানতে পারি, বিকাল ৫ টা ৩৫ মিনিটে শাহ আলী প্লাজার নিচে রাস্তায় পুলিশের ছুঁড়া গুলিবিদ্ধ হন ভাই। কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে প্রথমে ওইখানকার আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ওই হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাবা মো মাঈনুদ্দিন বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ছেলেকে ঢাকার মিরপুর ২ নম্বরে ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। অনত্র কাজ করে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনায় দিতে হয়েছে সর্বত্র, ঋণে জর্জরিত। তাকে ঘিরে কতইনা স্বপ্ন বুনেছি। তার কি অপরাধ ছিল যে সে গুলিতে নিহত হলো। কার কাছে চাইব বিচার? কে করবে বিচার, কে দিবে ক্ষতিপূরণ? ছেলেকে ত আর ফিরে পাবোনা, রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলে হত্যার বিচারটা করে, তাইলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাবো।
চাচা আব্দুর রহিম বলেন, রুস্তম হত্যার বিচার চাই।
চাচী লায়লী বেগম বলেন, রুস্তম খুব ভালো ছেলে ছিল। তাকে নিয়ে সবারই স্বপ্ন ছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল। ছেলে শোকে মা-বাবা পাগল পায়।
চাচাতো বোন জুলেখা ও শারমিন বলেন, ওই দিন সন্ধ্যা ৭ টায় হঠাৎ ফোনে চাচার কল আসে।
চাচা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, রুস্তম আর নেই, গুলিতে নিহত। লাশ বাড়িতে নিয়ে আসতেছি। রুস্তমের মৃত্যুর সংবাদ শুনে সবাই স্তব্ধ বনে গেলাম। রাত ২ টার পর লাশ নিয়ে বাড়িতে এলো। পরদিন শনিবার সকাল ১১ টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেয়া যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা নিতাই শাহা বলেন, ছেলেটা সময় পেলেই এলাকায় এসে বেড়াতো। তার মৃত্যু মেনে নেওয়ার নয়। খুব ভালো মনের পরহেজগার মানুষ ছিলো।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার নিহত হন ৯ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. রুস্তম(১৫)। ওইদিন রাতেই স্বজনরা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে ভোর রাতে বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন তার মরদেহ নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।