তাকসিম চক্রের পেটে ৫০০০ কোটি টাকা দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০২৪

ঢাকা ওয়াসা ভবনে তাকে বলা হয় সম্রাট। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে বলা হতো তার পকেট মন্ত্রী। ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের ভয়ে তটস্থ থাকতেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সম্রাট তাকসিমের বিদায় হলেও তার উজির নাজির পাইক পেয়াদা হিসেবে রয়েছেন র‌্যামস ও বাঁছুর গ্রুপ। তাদের দিয়েই গত ১৫ বছরে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজস্ব লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি। এদিকে পদত্যাগের পর তাকসিম এ খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার সংস্থাটি থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র দৈনিক মানবজমিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এক কর্মকর্তা বলেন, তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রকল্পে দুর্নীতিসহ বেশ কিছু অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।

সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তার বিদেশযাত্রা নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর আগে গত বছর ২৩শে মে ওয়াসায় অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলার অনুমোদনের জন্য সুপারিশ চেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এতে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয় পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগর) এই দুটি পদ ওয়াসার অর্গানোগ্রামে না থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির এমডি প্রভাব খাটিয়ে দুজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। আর চার বছরের বেশি সময় ধরে তাদের বেতন বাবদ ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা দেয়া হয়েছে।

 

নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ হওয়ায় এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। দুদক সূত্র মতে, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এরপর একাধিকবার সময় বাড়িয়ে ওই পদে আছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে বারবার নিয়োগবিধি অমান্য করার অভিযোগ উঠে। এ ছাড়া ওয়াসার এমডিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সংস্থাটির পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, গুলশান-বারিধারা লেক দূষণ প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই অনুসন্ধান করছেন।

এদিকে তাকসিমের বিদায় হলেও বহাল তবিয়তে রয়েছে তার দুর্নীতির সিন্ডিকেট র‌্যামস ও বাছুর গ্রুপ। তারা ইতিমধ্যে তাকসিমের দুর্নীতি সংক্রান্ত ফাইল গায়েব করা, তাকসিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ওয়াসার এমডি’র পদ থেকে পদত্যাগ করার পর ঢাকা ওয়াসার সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীরা তাকসিমপন্থি কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। তাদের মারধর ও হেনস্তা করতে গেলে বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারা এসে তাদের বাঁচিয়ে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার আগের দিন অর্থাৎ সর্বশেষ গত ৪ঠা আগস্ট পর্যন্ত অফিস করেন তাকসিম এ খান। এরপর থেকে তাকে আর অফিসে দেখা যায়নি। জনরোষে পড়ার ভয়ে নিজ বাসায় না থেকে এ সময় তিনি রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ভিন্ন নামে রুম বুক করে ওয়াসার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করতেন। বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন। সেখান থেকে অনলাইনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। পরবর্তীতে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরার একটি ফ্ল্যাটে আত্মগোপনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি তার অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ ফাইল গায়েব করান। কিছু ফাইল তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। তাকসিমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ওয়াসায় কর্মরত বদরুল আলমই মূলত এসব ফাইল সরানোর কাজ করছেন।

এদিকে ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটিকে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রভাব খাটিয়ে তিনি সেখানে দুর্নীতির সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। ওয়াসা সূত্র জানায়, তাকসিমের দুর্নীতিতে সক্রিয় ছিল তার স্টাফ অফিসার বদরুল আলম। তরুণ নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে তিনি ৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের পিডি বানিয়েছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদিন গত ৬ বছরে ওয়াসার যত টেন্ডারবাজি ও লুটপাটসহ সকল প্রকার দুর্নীতি করেছেন। এই তিনজনই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছেন। এবং প্রত্যেকেই বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ওয়াসাতে তাদেরকে বাঁছুর গ্রুপ নামে ডাকা হয়। তাদের আগে গত ৮ থেকে ৯ বছর যারা তাকসিমের দুর্নীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে বলা হতো র‌্যামস গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্য রফিকুল ইসলাম পদ্মা প্রকল্পের ডিজি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কয়েক শ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই গ্রুপের আরেক সদস্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান। তিনি বর্তমানে অবসরে গেছেন। তিনিও একটি প্রকল্পের পিডি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। রফিক এবং আক্তারকে দুদকে ডাকা হলেও তাকসিন তার ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে চাপা দিয়ে রেখেছেন। আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মহসেন আলী মিয়া দাসেরকান্দি প্রকল্পের পিডি ছিলেন। তিনিও বর্তমানে অবসরে গেছেন। তার বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান এসি তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুর সাত্তার সবুজ। তার বিরুদ্ধে টানা ৯ বছর সংগ্রহ বিভাগে (কেনাকাটায়) কয়েকশ’ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান ড. গোলাম মোস্তফা মানবজমিনকে বলেন, ওয়াসা তো দুর্নীতির চারণভূমি। এটা সকলেই জানে। তাকসিমকে দুর্নীতির পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত। এবং অনুতপ্ত। তাকে আমি নিজ দায়িত্বে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেও পরবর্তীতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়তার সুযোগের অপব্যবহার করেন। এ বিষয়ে আমি তখন মন্ত্রণালয়কে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়ার ৪ দিনের মাথায় আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌ. এ.কে.এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ওয়াসার সাবেক এমডিসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এটার আমি প্রমাণ চাই। অনুমানভিত্তিক কথা বললে হবে না। যথাযথ প্রমাণ দিতে পারলে আমি দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন গবেষণা করে এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ তুলে ধরলে তৎকালীন সরকার এটার গুরুত্ব দেয়নি। তার ক্ষমতার বলয় এত বেশি উচ্চ পর্যায়ে ছিল যে, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রেখে অবারিতভাবে দুর্নীতি করেছেন। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা অবারিতভাবে করে গেছেন তিনি। এখন প্রথম কথা হচ্ছে সাবেক এমডি তাকসিম পদত্যাগ করলেই তো হবে না। তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুন না কেন আমাদের আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব এবং অবশ্যই প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। এর মাধ্যমে জনস্বার্থে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতি তিনি এককভাবে করেছেন এটার কোনো সুযোগ নেই। তার সঙ্গে একটি চক্র ছিল এই প্রতিষ্ঠানের। যারা বহাল তবিয়তে থাকলে নিজেদের এবং তাকসিমের দুর্নীতিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে বর্তমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এটা প্রতিরোধ করার সুযোগ আছে। এবং যারা এই দুর্নীতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তাদেরকেও চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার সুনিশ্চিত ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এএসআই আশরাফুল ওই এলাকায় জমি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। এর জের ধরে মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এএসআই আশরাফুল ইসলাম একজনকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে ডেকে পাঠান। তিনি গেলে দুজনের মধ্যে একপর্যায়ে কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় মিজানুরকে মারধর করা হলে তাঁকে রক্ষা করতে নাসির নামের এক ব্যক্তি এগিয়ে যান। তাঁকেও মারধর করেন আশরাফুল। একপর্যায়ে আশরাফুল পিস্তল বের করেন। তখন স্থানীয় লোকজন তাঁকে ধরে পিস্তল কেড়ে নিয়ে পিটুনি দেন। পরে আশরাফুল ইসলামকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কেড়ে নেওয়া পিস্তল পরে সেনাবাহিনী গিয়ে উদ্ধার করেছে। মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছয়-সাত দিন আগেও তাঁরা (আশরাফুলরা) এসে তাঁর বাড়িতে হামলা করেছেন। আশরাফুল জমির ব্যবসা করেন। আজকে পিস্তল বের করে গুলি করতে চেয়েছিলেন তিনি। লোকজন ছিল বলে বেঁচে গেছেন বলে জানান মিজানুর। পরে লোকজন পিস্তল কেড়ে নেয়। সেনাবাহিনী এসে পিস্তলটি উদ্ধার করে নিয়ে গেছে বলে তিনি জানান।

LifePharm