শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সরকারের দেয়া বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত রয়েছে বিশ্লেষক ও বিরোধীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের দেয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে বক্তব্যে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র দেখা যায়নি বলে তাদের অভিযোগ রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে গত ২৮ আগস্ট একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম সভায় শ্বেতপত্রের মূল উদ্দেশ্য ও কাজের পরিধি নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই কমিটির প্রধান, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শ্বেতপত্র প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে, কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই আমাদের কাজ।’
শ্বেতপত্রে ‘মেগা প্রকল্প’ নিয়ে পর্যালোচনা করার কথাও জানান তিনি।
৯০ দিনের মধ্যে এটি সরকারকে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
এবার কি তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির‘সত্যিকার চিত্রটি’ দেখা যাবে?
শ্বেতপত্র কী, কেন করা হয়?
শ্বেতপত্রের ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে।
‘সরকারের দ্বারা প্রকাশিত কোনো নীতিগত নথি যেখানে সংসদীয় প্রস্তাবনা থাকে, সেগুলোই শ্বেতপত্র,‘ যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এভাবেই শ্বেতপত্রের বর্ণনা দেয়া আছে।
এর ফলে, অধিকতর আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ বিষয়ক জ্ঞানকোষ ইনভেস্টোপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে পার্লামেন্ট রিপোর্টের প্রচ্ছদ থাকতো নীল রঙের। যদি রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরকারের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হতো নীল প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে সাদা প্রচ্ছদেই সেগুলো প্রকাশ করা হতো। সেই রিপোর্টগুলোকে বলা হতো হোয়াইট পেপারস্।
তবে, আগে ‘বাংলাদেশে এ প্রথার প্রচলন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী‘ দেখা গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাতীয় জ্ঞান কোষ বাংলাপিডিয়ায়।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘এ প্রথা কোনো প্রস্তাবিত নীতি বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যার সাথে যুক্ত নয়। বরং কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিচালনার পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক শাসক দলের কুকীর্তির দলিল হিসেবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়।‘
যদিও, এবারেরটি ‘দুর্নীতি ধরার কমিটি নয়‘ বলে জানিয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
‘দুর্নীতি কেন হয়েছে এবং মাত্রাটা কী, সেটা বলবে এই কমিটি,‘ যোগ করেন তিনি।
‘কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে, কেন করেছে সেটা বলা আমাদের দায়িত্ব না,‘ উল্লেখ করে ভট্টাচার্য বলেন, এর জন্য সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে।
বাংলাদেশে শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে।
তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা তুলে ধরা হয়।
২০২১ সালে একদল বেসামরিক নাগরিকদের, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা একটি গণকমিশন গঠন করেন।
তারা পরের বছর ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন‘ নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে।
তবে,‘ইসলাম বিদ্বেষ’ এর অভিযোগে এটি নিয়ে সেসময় বিতর্ক দেখা দেয়।
অর্থনীতির‘হেলথ চেক আপ’
চলতি বছরের মে মাসে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশের ঋণ।
জানা যায়, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশের সার্বিক ঋণ ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
এর মধ্যে ৮০ ভাগই সরকারের ঋণ।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি স্থানীয় গণমাধ্যমও প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা।
বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেলো সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেক আপ‘-এর কথা বলেছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জাহিদ হোসেন।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবো। এটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মত।‘
এছাড়া ‘মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে‘ বলে তিনি বলছেন। এর ব্যাখ্যা হিসেবে জাহিদ হোসেন বলেন, পলিসি বা নীতিগত দিকটা কীভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে।
বৃহস্পতিবার প্রথম বৈঠক শেষে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করব না। তারল্যসঙ্কট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে।‘
‘আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে,‘ যোগ করেন তিনি।
পর্যালোচনায় থাকবে মেগা প্রকল্পও
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান।
আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেসোরেই প্রচার করে আসছিল।
তবে, পদ্মাসেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীরা।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন,‘তবে আমরা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবো। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় সেটা হয়তো আমার সহযোগীরা দেবেন।‘
কোন কোন মেগা প্রকল্প পর্যালোচনায় থাকতে পারে এমন প্রশ্নে কমিটির অন্যতম সদস্য জাহিদ হোসেন সময়ের বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এখনই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়, কাজগুলো কতদূর পর্যন্ত করা সম্ভব হবে।‘
সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে?
সম্প্রতি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের রফতানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামাঞ্জস্য ধরা পড়ে।
রফতানির বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
সরকারি সংস্থাগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।
ফলে তাদের দেয়া তথ্য উপাত্তের ওপর ভর করে পাওয়া চিত্র কতটা সঠিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেনও বলেন, ‘তথ্যেরও তো অনেক ধরনের সমস্যা আছে।‘
‘যা তথ্য অ্যাভেইলেবল আছে অর্থাৎ, বিবিএস (পরিসংখ্যান ব্যুরো), ইপিবি এবং অন্য সংস্থাগুলোর কাছে যা আছে তার ভিত্তিতে অর্থনীতির একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ণ এখানে আশা করা যেতে পারে,‘ যোগ করেন তিনি।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও জ্বালানি, অভিবাসন, উন্নয়ন ও সুশাসনের মত বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘নীতি বিশ্লেষক‘ বা ‘বিষয় বিশেষজ্ঞ‘ হিসেবে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দেবেন।
সূত্র : বিবিসি