উত্তাল দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাঁধে ছিল চবি’র যে ৮ শিক্ষকের ভরসার হাত

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তাদের কেউ ছিলেন সরাসরি মাঠে, ছাত্র-জনতার সঙ্গে। অনেকে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থেকে জনমত গড়েছেন আন্দোলনের পক্ষে। কেউ কেউ তো ওই সময় আটক হওয়া শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে আনতেও নিয়েছিলেন সোচ্ছার ভূমিকা। শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে গিয়ে তাদের অনেকেই পড়েছিলেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়, কারও কারও বাসায়  হয়েছে বোমা হামলা। তবুও শিক্ষার্থীদের কাঁধ থেকে সরেনি তাদের সমর্থনের হাত। চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ানো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এমন আট ছাত্রবান্ধব আর মানবিক শিক্ষকের নাম এখনো সবার মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাওয়া, শিক্ষার্থী অন্তপ্রাণ এই শিক্ষকদের হাতেই উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব তুলে দেয়া হোক।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গত ১২ই আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের। একই সময়ে পদত্যাগ করেন দুই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে ও অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী। এরপর থেকেই পরবর্তী উপাচার্য কে হচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেই আলোচনায় উঠে আসছে কোটা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা ৮ শিক্ষকের নামও।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত ১লা জুলাই বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ করে।

সমাবেশ থেকে ৪ দফা দাবি পেশ করেন তারা। এটি ছিল চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের প্রথম কর্মসূচি। এই কর্মসূচি চলাকালীন শিক্ষার্থীদের সামনে গিয়ে ছাত্রলীগ হুমকি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও উপাচার্যকে এ ঘটনায় অভিযোগ জানানো হলেও তারা কোনো সহযোগিতা করেননি বরং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না করার ‘পরামর্শ’ দেন প্রক্টর অহিদুল আলম।

 

এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসেন কিছু জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তারা গঠন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্য নামে একটি প্ল্যাটফরম। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়ক হন অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য ও ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান। তার সঙ্গে এই প্ল্যাটফরমে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন, অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম, ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহিদুল হক ও সহকারী অধ্যাপক খন্দকার আলী আর রাজি।

১৫ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়ক শামীম উদ্দিন খানের নেতৃৃত্ব এই শিক্ষকেরা শহরে আন্দোলন শুরু করেন, সহযোগিতা করেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়ার আহ্বান জানান। সেজন্য তাদের হাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তুলে দেয়ার দাবি শিক্ষার্থীদের।

ভিসি কে হবেন এই আলোচনায় তাই শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়ায় শিক্ষার্থীদের বড় অংশ তাকে ভিসি হিসেবে চাইছেন। একাডেমিক যোগ্যতাও তার হয়ে কথা বলছে। গণিত বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ভারত থেকে রিসোর্স ইকোনমিক বিষয়ে পিএইচডি করেন ড. শামীম। ক্যাম্পাসে তার শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হিসেবে বেশ পরিচিতি রয়েছে। নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন সময়ে তার ব্যাপারেই একাডেমিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশংসা শোনা যায়। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলন ও মানবাধিকার প্রশ্নে বেশ জোরালো ভূমিকা রাখায়  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা করছেন শিক্ষার্থীরা। ভিসির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক শামীম, সেদিক দিয়েও অন্যদের তুলনায় উপাচার্যের দৌড়ে এগিয়ে তিনি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তীব্রতার মধ্যে ৩০শে জুলাই প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান ও দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের বাসায় বোমা হামলা চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শৈবাল ইসলাম মাসুদ, আবু বকর তোহা ও ছাত্রলীগ নেতা আবির ইকবালের নেতৃত্বে রাত আনুমানিক ২টার দিকে এ হামলা চালানো হয়। ১০-১৫টি মোটরসাইকেলযোগে ওই এলাকায় যায় হামলাকারীরা। পরদিন ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলেও এই শিক্ষকরা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান আন্দোলন উজ্জীবিত করতে কবিতাও রচনা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী শেয়ার করেন। ঝুঁকির মুখে পড়েও শিক্ষার্থীদের পাশে থাকায় এই শিক্ষক রয়েছেন আলোচনায়। ড. আতিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডি করেছেন জাপানের এহেমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা কাজের সঙ্গে জড়িত। চবির গবেষকদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন এই অধ্যাপকের অবস্থান।
শিক্ষার্থীর পছন্দের তালিকায় আছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ড. মো. কামাল উদ্দিনও। এই দুইজনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। গণহত্যা চলাকালে ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের বক্তব্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনমুখী রাখতে অনুপ্রাণিত করে।
ছাত্রছাত্রীদের  আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখা শিক্ষকদের অন্যতম হচ্ছে দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব  বলে পরিচিত এই শিক্ষক আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। স্ত্রী দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামসুন্নাহার মিতুলকে নিয়ে শহর ও ক্যাম্পাসে  কোটা আন্দোলনের প্রায় সবকটি প্রোগ্রামে সামনের সারিতে থাকতেন তিনি। যে কারণে ৩০শে জুলাই ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার বাসায় বোমা হামলা চালায়।

আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল হক। গণহত্যার প্রতিবাদে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়া সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবাদ করেছেন তিনি। নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই শিক্ষক। একই বিভাগের আরেক শিক্ষক খন্দকার আলী আর রাজিও আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সক্রিয় ছিলেন। এমনকি তিনি  আটক হওয়া চবির শিক্ষার্থীদেরকে  ছাড়িয়ে আনতে থানায় দৌড়ঝাঁপ করেন।

কেমন ভিসি দেখতে চান- এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিশাদ হোসাইন বলেন, গণহত্যা চলাকালে চবি শিক্ষক সমিতি একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। পরে জেনেছি সমিতির নেতারা আওয়ামীপন্থি। এজন্য শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে গিয়ে ফ্যাসিস্টের দালালি করেছেন। এরা যেন প্রশাসনিক কোনো দায়িত্বে না আসেন। আন্দোলন চলাকালে যেসব শিক্ষক ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্য থেকে উচ্চমানের একাডেমিক চর্চা, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এমন কাউকে ভিসি হিসেবে দেখতে চাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক  রাসেল আহমেদ বলেন, বিগত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাযথ একাডেমিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরিবর্তে, বিভিন্ন অনিয়ম ও নিয়োগে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কেবলমাত্র একটি কর্মসংস্থানের স্থানে পরিণত করা হয়েছে। দলীয় পরিচয়ের মাধ্যমে নিজের সিন্ডিকেট রাজ্য আমরা আর দেখতে চাই না। উপাচার্য হিসেবে এমন একজন দায়িত্ব পান, যিনি নিজের স্বার্থে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য কাজ করবেন।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm