প্রশ্নবিদ্ধ দুদক এখন কী করবে?

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দুর্নীতিবাজদের ধরা ও তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থার জন্যই মূলত প্রতিষ্ঠা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের। প্রতিষ্ঠার দুই দশক কেটে গেলেও গণমানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। বলা চলে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ফরমায়েশে চলে এর কার্যক্রম। অনেকটা দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থাটি।  কমিশনের লেজুড়ভিত্তিক দলীয়   নিয়োগের ফলে গোড়াতেই গলদ।  ফলে কখনোই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না দুদক। গত ১৫ বছরেও তাই হয়েছে। পাঁচ বছর পর পর কমিশন বদলেছে কিন্তু দায়িত্ব পালন করা মানুষগুলো সরকারি দলের প্রেসক্রিপশনে কাজ করেছে। কেউ কেউ বলেই থাকেন দুদক একটি নখদন্তহীন বাঘ। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।

পদত্যাগ করে পালিয়েছেন প্রায় ১৬ বছর শাসন করা এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ এই সময় অনেকটা তার ইশারায় দুদকের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছেÑ এমনটা দাবি করেছেন খোদ দুদকেরই কর্মকর্তারা। তবে ক্ষমতার পালাবদলে রাতারাতি পাল্টে যায় দৃশ্যপট। শুরু হয়ে যায় দুদকের সক্রিয়তা। একের পর এক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামা শুরু করে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশন। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শত হাজার কোটি টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের আইন অনুযায়ী তাদের সম্পদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। অথচ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাধর এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কম অভিযোগ জমা পড়েনি সংস্থাটিতে। বরং বিভিন্ন সময় শুরু হওয়া অনুসন্ধানগুলো চলমান অবস্থাতেই ক্লিন সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে তাদের। আবার অনেক অভিযোগ আমলে না নিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে কমিশন।  এসব নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলেও সদুত্তর দেননি চেয়ারম্যান-কমিশনাররা। এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পর তার আমলে দায়িত্ব নেয়া ও ফরমায়েশি অনুসন্ধানে নামা দুদকের তিন শীর্ষ কর্তা কী করবেন সেটা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। বলা হচ্ছেÑ অন্যান্য দপ্তরের মতো দুদকের চেয়ারম্যান-কমিশনাররাও কি পদত্যাগ করবেন কিনা?
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দায়িত্ব নেয়া বর্তমান কমিশন শপথ নেয় ২০২১ সালের মার্চে। সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের মতোই মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহও অনেকটা সে পথেই হাঁটেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি’র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিট দায়েরে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে এই কমিশন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের এমপিদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ অনুসন্ধানগুলো ধীরে চলো নীতি কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিসমাপ্তি করেছে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী ও শুদ্ধি অভিযানের পর অক্টোবরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে ছিল এমন অভিযোগ। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পাঁচ সংসদ সদস্যও ছিলেন। তারা হলেন তৎকালীন সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি সামশুল হক চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বাবু, সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং বরিশাল-৪ আসনের পঙ্কজ দেবনাথ। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠা অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম দ্রুত শেষ হলেও পাঁচ সংসদ সদস্যের সবার অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি।

দুদক সূত্র জানায়, হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মাদক ও তদবির বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তবে প্রায় সাড়ে তিন বছর পর সংস্থাটি  ২০২৩ সালের ৮ই মে অনুসন্ধান পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। দুদকের সাবেক সচিব মাহবুব হোসেনের স্বাক্ষর করা প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়।

দুদকে আসা উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মধ্যে তদন্ত শেষে যাদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেয়া হয়েছে তাদের একজন ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ আসে। মূল অভিযোগ ছিল কমিশন বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন। এরপর অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কিন্তু ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে জ্যাকবকে অব্যাহতি দেয় দুদক।

এ ছাড়া ২০২০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল। এমনকি তখন তার সম্পদের হিসাবও নেয় কমিশন। কিন্তু ২০২১ সালের মার্চে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কমিশন।

কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ৭৫৩টি এবং ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩১২টি ফাইল অনুসন্ধান পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব তালিকায় রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নুরুল আনোয়ার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনজুরুল আলম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক একেএম মমতাজ উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডর সদস্য এস এম হুমায়ূন কবীর, ডেসকো’র প্রধান প্রকৌশলী এনামুল হক, যুগ্ম সচিব জালাল আহম্মেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ-কর কমিশনার হুমায়ূন কবীর, বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল বাশার পাটোয়ারি, সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-সচিব দীপংকর রায়সহ এক হাজারের বেশি ব্যক্তিকে ছাড় দেয় দুদক।

অন্যদিকে গত তিন বছরের হিসেবে প্রায় দুই ডজন বিএনপি’র প্রথম সারির নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা ও চার্জশিট দিতে দেখা গেছে। কিছু কিছু মামলায় তাদের সাজাও হয়েছে।

ড. ইউনূস প্রসঙ্গ
দুদক শুধু বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধেই মামলা, চার্জশিটে ব্যস্ত ছিল না। বিগত দুই বছরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান, মামলা এমনকি দ্রুত চার্জশিট দিয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার তিন দিনের মাথায় তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় সংস্থাটি। এ নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই দাবি করেছেন, ড. ইউনূস যদি অর্থ আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িতই থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার কেন করেছে দুদক? অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপর কেন শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্বে থাকা এমপি- মন্ত্রীদের ধরা হচ্ছে?

এমন প্রশ্নের জবাবে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি বলেন, ‘যে কোনো অভিযোগ এলে তা যাচাই বাছাই করে তা অনুসন্ধানের আওতায় নেয়া হয়। এক্ষেত্রে একটি টিম কাজ করে। সেখান থেকে সময় লেগে যায়।’

প্রসঙ্গ আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টিও। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই কমিশনই তার (ইউনূস) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং চার্জশিট দাখিল করে। হঠাৎ সরকারের ক্ষমতা বদলের পরপর কেন সেই মামলা প্রত্যাহার করে দুদক? এ ব্যাপারে অনেকটা কৌশলে এড়িয়ে যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। এ ব্যাপারে মন্তব্য না করি।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm