ঘুষ ছাড়া পণ্য খালাসের অনুমতি মিলে না চট্টগ্রাম কাস্টমসে

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪

ঘুষ ছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি পণ্য খালাসের অনুমতি মিলে না। চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিরুদ্ধে অভিযোগটি পুরনো হলেও তা চলমান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ ধারা আরও বেগবান হয়েছে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের কারণে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলেও ওজন কম-বেশি হওয়ার মতো ঠুনকো অজুহাতে চালান আটকে দিচ্ছে ওই চক্রটি। ফলে বন্দরে দীর্ঘ সময় পণ্য পড়ে থাকায় পোর্ট ডেমারেজসহ নানা ধরনের মাশুল গুনতে হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। অবশেষে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিলেই মিলছে পণ্য খালাসের অনুমতি।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঘুষের প্রতিবাদ করায় সিএন্ডএফ এজেন্টের সদস্যরা প্রতিনিয়ত ওই চক্রের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা এ নিয়ে একাধিকবার কর্মবিরতি পালন করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আর এতে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনকালে চট্টগ্রাম কাস্টমসের হয়রানির বিষয়ে একাধিক আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের ফাইল আটকে রেখে হয়রানি করা হতে পারে এমন আশঙ্কায় নিজেদের পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।
ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা অভিযোগ করেছেন, ডেপুটি কমিশনার কাজী ইরাজ ইসতিয়াক সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ব্যবসায়ীদের অনেক ফাইল আটকে দিয়েছেন। প্রচলিত কাস্টমস বিধি না মেনে বা নিকটতম সময়ে আমদানিকৃত একই পণ্যের রেফারেন্স আমলে না নিয়ে ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসূত মতামত দিচ্ছেন। অধিকাংশ ফাইলে ‘আলোচনা করুন’ লিখে দিচ্ছেন। আর সেই আলোচনা চলছে ১০-১৫ দিন ধরে। এভাবে সময়ক্ষেপণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই কর্মকর্তার অধীনে সরকারি পণ্য, ডিউটি ফ্রি বন্ডের পণ্য, সরকারি প্রকল্পের মালামাল, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর মালামাল এবং কেমিক্যাল খালাসের ফাইল ছাড় হয়। তিনি ফাইলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁকফোকর বের করেন। এমনও দেখা যাচ্ছে, ১০ দিন আগে নিজে ফাইল ছাড় করেছেন এমন পণ্যের নতুন চালান খালাসের ফাইল উত্থাপিত হলেও নতুন করে বাধার সৃষ্টি করছেন।
কাস্টমসের হয়রানির বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘কাস্টমসে আমাদের সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফাইলে সবকিছু ঠিক থাকার পরও আপত্তি দেয় কাস্টমস। আবার কিছু ক্ষেত্রে দাখিল করা ফাইলে সত্যিই ত্রুটি থাকে। ফলে ত্রুটি সারিয়ে পণ্য খালাস করতে হয়।’

অভিযোগের বিষয়ে ডেপুটি কমিশনার কাজী ইরাজ ইসতিয়াক বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টারোধ করলেই কাস্টমসের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হয়রানির অভিযোগ তোলেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণত, ফাইলে কোনো ঝামেলা না থাকলে কাস্টমস সেই ফাইল আটকে দেয় না। আর কোনো ফাইল আটকে গেলে আমি একক সিদ্ধান্ত দেই না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত দেই।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা আমদানি-রপ্তানিকারকদের কীভাবে হয়রানি করছে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়- এখন হয়রানির অন্যতম কৌশল হয়ে উঠেছে ওজন পদ্ধতি। আর এই পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার জন্য আমদানি করা পণ্য চালানের ওভেন কাপড় আমদানি হয় গজ বা মিটারে। কিন্তু কাস্টম হাউস পরীক্ষার সময় ওই কাপড় পরিমাপ করে ওজন বা কেজি ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে ওজনে কিছুটা কমবেশি হলেই আটকে দেওয়া হয় আমদানিকৃত কাপড়ের চালান।

আবার আমদানি কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির চালান পরীক্ষার সময় ওজন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হয় পলি, কার্টন ও বোর্ডসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যের ওজন। পণ্য চালানের বিভিন্ন সাইজের কার্টনের ওজন পরিমাপ না করেই এক সাইজের কার্টনের ওজন পরিমাপ করেই বের করা হয় কার্টনের সর্বমোট ওজন
আনুষঙ্গিক দ্রব্যের প্রকৃত ওজন বের না হওয়ায় তারতম্য তৈরি হয় আমদানির সঙ্গে রপ্তানি পণ্যের ওজনে। এই ওজন কমবেশির অজুহাতে রপ্তানি পণ্যের চালান আটকে দিচ্ছে কাস্টম হাউস। এতে লোকসানে পড়ছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, ওজনে কমবেশির অজুহাতে রপ্তানি চালান আটকে দেওয়ায় অতিরিক্ত পোর্ট ডেমারেজ চার্জ পরিশোধ করতে হয় তাদের।

পোশাক কারখানার জন্য কাপড় আমদানি এবং প্রস্তুতকৃত পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এসএম আবু তৈয়ব বলেন, ‘রপ্তানির সময় কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ রপ্তানিকারকরা কতটুকু পণ্য রপ্তানি করছেন তা ওজন হিসেবে পরিমাপ করা শুরু করেছেন গত সাত-আট মাস আগে থেকে। এর আগে এই পদ্ধতি ছিল না। আমরা মনে করি, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ওজন পরিমাপের বিষয়টি হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতায় শুধু এক্সেসরিজের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারনামা প্রদান সাপেক্ষে পণ্য চালান খালাসের নির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে কাপড়ের উল্লেখ না থাকায় কাস্টম হাউস, চট্টগ্রামের মাধ্যমে আমদানিকৃত কাপড় ছাড়করণের ক্ষেত্রে এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতায় অঙ্গীকারনামার পরিবর্তে ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ সাপেক্ষে খালাসের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে কারখানাগুলো এটি প্রতিপালন করতে পারছে না। ফলে পণ্য চালান খালাসে দেরি হওয়ায় রপ্তানিতেও বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।

ওজন সম্পর্কিত অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টম হাউসের উপকমিশনার নাজিউর রহমান মিয়া বলেন, ‘ওজন কমবেশির অজুহাতে রপ্তানিকারকদের হয়রানি করা হচ্ছে এই অভিযোগটি সঠিক নয়। পরীক্ষায় যদি ওজন কমবেশি পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে আইনানুগ যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সেটিই গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে ওজন ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমবেশি হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।’
এদিকে, ওজন পদ্ধতির কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উল্লেখ করে বিজিএমইএ নেতা মহিউদ্দিন রুবেল জানান, এ জটিলতা কাটানোর অনুরোধ জানাতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গত ১৫ মে বৈঠক করেন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতারা। বিজিএমইএর সভাপতি এসএম মান্নানের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী নেতারা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে হয়রানি বন্ধে কাস্টমসের তরফ থেকে সহযোগিতা কামনা করেন।

এর আগে ১৩ মে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গেও বৈঠক করেন বিজিএমইএ নেতারা। মন্ত্রী সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির বিষয়টি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করবেন- এমন আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
LifePharm